আকবর সাহেব বারান্দায় বসে আছেন এক বাটি গরুর ভুনা মাংস নিয়ে। শীতের সকালের মিষ্টি রোদ উপভোগ করবেন আর গরুর মাংসের সাথে গরম গরম চিতই পিঠা খাবেন।
চিতই পিঠার জন্য অপেক্ষা করতে করতে তিনি এক দুই টুকরো মাংস খেয়ে ফেলেছেন। মাংসটা বেশ ভাল রান্না হয়েছে, ঝাল,তেলম মশলা সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে। তাজা গরুর মাংসের মজাই আলাদা। অবশ্য বয়স হয়েছে এখন একটু মেপে মেপে খাওয়া দাওয়া করেন, অবশ্য উনি খাবারের ক্ষেত্রে সর্বভুক।
অনেকক্ষন হয়ে গেছে পিঠা আসার নাম নেই। মেজাজ চড়ে যাচ্ছে। ধুর ছাই নাছিমা যে কি করে, এতক্ষন লাগে চারটা পিঠা বানাতে? নিশ্চয় কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। তা না হলে এতক্ষণ কেন লাগবে নাস্তার পিঠা আসতে। তিনি চিৎকার করে তার ছেলে রাকিবকে ডাকলেন। রাকিব কাছে আসতেই হুংকার দিয়ে বললেন, কখন থেকে বসে আছি পিঠার জন্য পিঠা নিয়ে আসতেছিস না কেন ? নাস্তা কি দুপুরে খাব নাকি!
বাবা পিঠা হয়নি। রাকিব মিন মিন করে বলল।
মানে?
রাকিব কাচুমাচু করে কিছু একটা বলার আগেই মিসেস আকবর এসে হাজির । তিনি বিরক্তি হয়ে বললেন, কি হয়েছে অমন ষারের মত চেচাচ্ছ কেন। গ্যাসের চুলায় মাটির হাড়ি কি থাকে ? হাড়িতে যেই পিঠার গোলা দিতে যাব অমনি হাড়ি গেল ভেঙে।
বাধ্য হয়ে কড়াইতে বসালাম ওটাতে পিঠা হচ্ছে না, বার বার লেগে যাচ্ছে। বাসায় আজ আর পিঠা হবেনা।
কত করে বলেছি একটা পিঠার ছোট্ট লোহার কড়াই কিনে দাও । তা না উনি মাটির খোলার পিঠা খাবেন, এখন এখন মজা বুঝ।
আকবর সাহেব বললেন, কি আর বুঝবো। আমি যখন পিঠা খেতে চাই তখনই পিঠা হয় না।
এই রাকিব যা তো রাস্তার মোড় থেকে পিঠাওয়ালির কাছ থেকে পাঁচটা চিতই পিটা নিয়ে আয়।
রাকিব বলল এত সকালে কি পিঠা পাওয়া যাবে?
পিঠা পাওয়া যাবে নাকি আমার মাথা পাওয়া যাবে সেটা রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখ। সারা রাত মোবাইল টিপিস, উঠিস নয়টায়। তোকে যেতে বলছি যা হারামজাদা, দৌড়ে গিয়ে পিঠা নিয়ে আয়। এই বলে তিনি পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ছেলের হাতে গুঁজে দিলেন।
তোরা তো নবাবের ব্যাটা দশটার আগে ঘুম থেকে উঠিস না । পিঠাওয়ালী গরিব মানুষ ওদের রুজি রোজগার এই পিঠা বেঁচে হয়। কি শীত কি গরম কাল সবসময় ওরা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে। গরিবের নিয়ম আছে বড়লোকের ঘরে কোন নিয়ম নেই।
গরম গরম পিঠা নিয়ে আয় যদি আজকে দেরি করিস তাহলে খবর আছে।
বাসার কাছের মোড়ে চলে যায় রাকিব। বাবা রাগী মানুষ বাবাকে সে ভয় পায়। রাকিব মোড়ে এসে দেখে পিঠাওয়ালী নেই কিন্তু পিঠার সব সরঞ্জাম রয়েছে। সে কি করবে ভেবে না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যায়। বাবাকে বলে পিঠাওয়ালী কোথায় যেন গিয়েছে কিন্তু আকবর সাহেব বিশ্বাস করেন না ।
পিঠাওয়ালী আবার কোথায় যাবে নিশ্চয় বাসায় গিয়েছে। তুই আবার যা যতক্ষণ না পিঠা হাতে পাবি ততক্ষণ বাসায় ফিরবি না।
রাকিব আবার বাসার মোড়ের কাছে গিয়ে দেখল পিঠাওয়ালী তখনো ফিরিনি । সে খালি চেয়ারে বসে থেকে তার বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ায় গল্প করে কিন্তু তবুও পিঠাওয়ালী ফিরেনা।
বাবার কাছ থেকে আবার গালি খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বাসায় ফিরল। আকবর সাহেব রাকিবকে
দেখেই বুঝে গেলেন যে সে পিঠা নিয়ে আসতে পারিনি। তাই তিনি হতচ্ছাড়া বদমাশ বলে ছেলেকে ধমক দিলেন। সব কাজ আমাকেই করতে হবে একটা কাজ যদি পারে, এই ছেলেকে দিয়ে কি হবে !
শীতের সকালটাই মাটি করে দিল। ইস কেন যে আজই পিঠা খেতে ইচ্ছে হলো ! এই বলে তিনি গুনগুন করে নিজেই চলে গেলেন রাস্তার মোড়ে।
গিয়ে দেখলেন কয়েকজন পিঠার জন্য দাঁড়িয়ে আছে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন। প্রায় দশ মিনিট পর পিঠাওয়ালী আসলো। সে দুই হাতে চিতই পিঠা বানিয়ে কাস্টোমারদের বিদায় করলো। আকবর সাহেব জানতে চাইলেন সে এতটা সময় কোথায় ছিল পিঠা বানানো বন্ধ রেখে।
পিঠাওয়ালী বলল ঘরে পংঙ্গু স্বামী। তারে খেদমত করতে হয় । ছেলে স্কুলে চলে গেছে আর মেয়ে গেছে কলেজে।
পিঠাওয়ালী যে মধ্যবিত্ত ঘরের বউ সেটা তার কথা ব্যবহার ও আচরণে বুঝা যায়। আকবর সাহেব সাজিয়ে রাখা চেয়ারের একটাতে বসলেন। বললেন, তোমার ছেলে মেয়ে স্কুল কলেজে পড়ে।
পিঠাওয়ালী বলল হ রে ভাই। কপালের ফেরে আজ পিঠা বানাই রাস্তায় বসে। একটা সময় কত সুন্দর সব চলছিল আমার পরিবার। স্বামী চাকরি করতো, আমি সেলাই কাজ করতাম বাসায় বসে। দুজনের আয়ে সংসার ভালোই চলে যাচ্ছিল কিন্তু অফিস থেকে একদিন ফেরার পথে মানুষকে গাড়ি এক্সিডেন্ট করল, সেই থেকে সব শেষ হয়ে গেল।
শহরের বাড়িতে বইসা থাইকা আর কয়দিন খাওয়া যায় ভাই কন, সংসারের খরচ, ছেলে মেয়ের স্কুল কলেজের খরচ, কুলকিনারা না দেইখা আমি এই পিঠা লইয়া বইলাম।
সারা বছর পিঠা বানাই দেখেনইতো আপনাগো চোখের সামনে, পাটিসাপটা, চিতই, আন্দাসা, ডিমপুলি, সংসা পিঠা, ভাপা পিঠা, মেরা পিঠা, কুলি পিঠ, তালের পিঠা......................................।
পিঠাওয়ালী সাথে কথা শেষ করে তাকে সান্তনা দিয়ে আকবর সাহেব বাসায় ফিরেন। তিনি গরুর মাংস আবার গরম করে চিতই পিঠা খাওয়া শুরু করেন।
খেতে খেতে তার শৈশবের কথা মনে পড়ে । মনে পড়ে মায়ের মুখ, মনে পড়ে বাবাকেও। প্রতিবছর শীতকালে তাদের নাস্তাই ছিল পিঠা । বিশেষ করে ভাপা পিঠা, পাটিসাপটা কিংবা দুধ চিতই ।
আহা ! সেইসব দিন আর কখনো ফিরে আসবে না জীবনে। কি দিন গিয়েছে আর এখনকার পোলাপান পিঠার কথা শুনলেই মুখ বাঁকা করে ফাস্টফুড খায় আর পেটের ব্যামো বাড়ায়।
বেশ কদিন পর বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড় পেরিয়ে বাজারে যাবেন এমন সময় আকবর সাহেব দেখতে পেলেন পিঠাওয়ালী ও তার ছেলে মিলে অনেক পিঠা তৈরি করছে। বিশেষ করে মানুষ ভাপা পিঠা খাচ্ছে বেশি, শীত এলেই শহুরে মানুষ ভাপা পিঠা খেতে পছন্দ করে। আকবর সাহেব কাছে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন তিনি সরিষা বাটা দিয়ে চিতই পিঠা খেতে লাগলেন । তারপর টুকটাক গল্পসল্প করতে লাগলেন পিঠাওয়ালীর সাথে। মানুষের টুকরো টুকরো এই সব সুখ দুঃখের কথা শুনতে তার বেশ ভাল লাগে।
পিঠাওয়ালী কথা কথায় জানায়, ভাইজান দোয়া করবেন সামনের মাস থেকে হাতের বা পাশের দোকানটা ভাড়া নিছি। এখানেই পিঠা বিক্রি শুরু করব।
বাহ বেশ ভাল কথা, তা নিজে একলা সামলাতে পারবেতো দোকান।
আমার পোলায়ও সাথে থাকবো। মা পোলা দুজন মিলে দোকান চালামু। এভাবে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে আর পিঠা তৈরি করতে মন চায়না, শরীরও দেয়না। যা পুঁজি জমেছে সেটা দিয়ে এবার দোকান নিব আপনারা পাশে থাকবেন, দোয়া করবেন।
আকবার সাহেব বলন, তোমার দোকান হলে ভালই হয়, মন চাইলেই দোকানে পিঠা খেতে আসতে পারবো। অফিসের কোন অনুষ্ঠান হলে এখন থেকে তোমার দোকানে পিঠার অর্ডার দিতে হবে দেখছি।
আস্তে আস্তে পিঠাওয়ালীর প্রসার বাড়তে থাকে। বছড় জুড়ে সে পিঠা বানায়। তার পিঠার হাত ভাল। এভাবেই পিঠাঘর নামের দোকানটি পরিচিতি লাভ করে। আজকাল অনলাইনেও পিঠার অর্ডার নেয় পিঠাওয়ালী।
‘শীতের সকালে গরম গরম পিঠার স্বাদ নিতে চলে আসুন পিঠাঘরে’। পিঠাঘরের হোম পেজে এই লেখাটি দারুন প্রভাব ফেলে অনলাইন কাস্টমারদের উপর।
এভাবেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষ, খুঁজে নেয় নিজের জন্য বেঁচে থাকার উপায়।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
পিঠা বিক্রি করে যে নারী হয়ে উঠেন স্বাবলম্বী সেই পিঠাওয়ালীকে গল্পে তুলে ধরা হয়েছে।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪